অসংলগ্ন ১.২

প্রথা ভাঙার গল্প … বিশাল লেখা

আমার না, আমার নানা আর বাবার গল্প। আমার বড়খালা, বড়খালার জন্মের পর তিন খানা মামা হয়ে মারা গেছেন, তারপরে মেজ খালা, তারপরে এক মামা হয়ে মৃত্যু আর তারপরে আমার মা। আমার মা কাল। এমন অবস্থায় ১৯৫৭ সালে কেমন অবস্থা হয় সেটাতো বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা না। মা হওয়ার পর, নানার বাবা নানাকে চিঠি লিখলেন যে নানা যদি আরেকটা বিয়ে না করেন, তাহলে তাকে ত্যাজ্য করা হবে। নানা কাজ করতেন কলকাতায়। উত্তর দিলেন “আমার মেয়েরা এমন কাজ করবে যে দেশের ছেলেদের তারা চাকরি দিতে পারবে। আর আপনি যদি তাঁদের জন্য এই দোয়া না করতে পারেন, তবে তাদের সুস্বাস্থের আর সুস্থ জীবনের দোয়া করেন, দেশের বাড়িতে থেকে তাদের দেখভাল করার কষ্ট করতে হবেনা” (এই চিঠি আমার কাছে আছে)। নানা আমার মা-খালাসহ নানুকে নিজের কাছে নিয়ে গেলেন। পরবর্তীতে আমার দুই মামা হয়েছেন পরে, কিন্তু নানার বাসায় আর ফেরা হয়নি।

 

বড় খালা ফর্সা, টুকটুকে সুন্দরী ছিলেন। কলেজে পড়তে সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হোল, নানা খুব ভয়ে তার বিয়ে দিয়ে দিলেন। মা তখন ক্লাস এইটের ছাত্রী। এক বছরের মাঝে খালার ছেলে হয়ে যাওয়া এবং খালু খুব বিদ্বান আর মুক্তমনা সত্ত্বেও সুন্দরী খালার ঘরে আটকে থাকা দেখে ১৯৭২ সালে নানার সিদ্ধান্ত যে আর দুই মেয়েকে কোন অবস্থাতেই চাকরি পাওয়ার আগে বিয়ে দিবেন না। আমার মেজখালা ছিলেন দুর্দান্ত দুষ্টু মেয়ে। তারা তখন তাদের দাদাভাইয়ের মানসিকতা বুঝে গেছেন। দাদাভাইও তখন তার ছেলের বাড়িতে আসাযাওয়া করেন, দু’খানা নাতি বলে কথা! মেজ খালা পায়জামা গুটিয়ে হাফ প্যান্টের মত করে স্কুলকলেজে যেতেন। দাদাভাই সেটা দেখে মেজাজ খারাপ করে বাসায় এসে আমার নানু আর নানাকে বলতেন। নানু তাও মাঝে সাঝে একটু বক্তেন যে বুড়া মানুষকে খেপায় কেন, নানা খালি হাস্তেন-কিচ্ছুই বলতেন না। মেজ খালা রাজশাহী ইউনিভার্সিটি আর মা ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী তখন। খুলনা শহরের মানুষজন নানাকে ভালই চিনতেন, তারা উপকার করতে এগিয়ে আসলেন। দুই মেয়ে পিঠা-পিঠি। তারা “ফরসা-সুন্দরি” না, শুকনা-হ্যাংলা। তাদের বিয়ে তখনি না দিলেতো ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমার চুপচাপ হাসিমুখের নানা তখন জীবনে প্রথম হুঙ্কার দিয়ে দাঁড়ালেন। মেয়ের বিয়ে দিবেন না। খুব টাকাপয়সা ছিলনা তাঁদের, তবুও পুরো দুনিয়ার বিরুদ্ধে স্থির হয়ে থাকলেন। আমার খালার গল্প শুনি, একবার উনি ছুটিতে বাড়ি গেছেন, পাড়াপ্রতিবেশি এবং “আত্মীয়” বাসায় বরপক্ষ নিয়ে এসেছে মেয়ে দেখতে, মেয়ে যেহেতু অনার্স ফাইনাল ইয়ারের কাল, শুকনা ছাত্রী, পাত্র হোল বিপত্নীক ৩০-উরধ লোক, যে কিনা আবার আমার খালাকে রিজেক্ট করেছে সে কাল দেখে। মেহমানের সামনে নানা কিছু বলেনি, ঐ “বরপক্ষ” চলে গেলে নানা আর নানু ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে তাঁদের “আত্মিও”দের বলে দিলেন এর পরে তাঁদের বাড়িতে ঢুকলে খুন করে হাতে মাথা ধরিয়ে দিবে। খালা এবং মা লজ্জায় বাড়িতে যাওয়া কমিয়ে দিলেন। ছুটিতে তারা যেতেন বড় বোনের বাড়িতে চট্টগ্রামে, যেখানে সুন্দরী বড় বোন তখন ১৫০ কেজি ওজন নিয়ে এইচএসসি পাস- দুই ছেলের মা। বোন এবং দুলাভাই তাঁদের আড়াল করে রাখতেন যেন কেউ বিয়ের প্রসঙ্গে কথা না বলতে পারে। আমার মা আর মেজ খালার মাস্টার্স পড়ার সময়ে বেশ কয়েকটা বিয়ের প্রপোজাল আসে, কিন্তু কাল-বেশি বয়স হয়ায় সেগুলো “না” হয়ে যায়। তাঁদের মাঝে সরকারী চাকরিজীবী, ভাল ব্যাবসায়ি, আর্মি অফিসারসহ “ভাল ভাল” প্রফাইলের মানুষ ছিলেন, যাদের কয়েকজনকে আমরা এখনো চিনি। আমার নানা পাহাড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন, মেয়েরা চাকরি পাওয়ার আগে বিয়ে দিবেন না। খালা মাস্টার্স পাস করে গার্মেন্টস লাইনে কাজ করতে ঢুকলেন, তখন মাত্র দেশে গার্মেন্টস সেক্টর শুরু হচ্ছে, ১৯৮২ সালে। মা বি সি এস পাস করে প্রশাসন ক্যাডারে ঢুকলেন একই সালে। খালা অবিবাহিত মেয়ে, এডমিন্সট্রেশন কাজ করছেন গার্মেন্টস এর মতো নতুন সেক্টরে, নানা তাঁকে পরামর্শ দিলেন বড় খালার বাসায় থেকে কিছুদিন কাজ করাতে যাতে কেউ উলটোপাল্টা কথা না ছড়াতে পারে, আর নিজে গেলেন আমার মায়ের প্রথম পোস্টিং কুষ্টিয়ায় তার সাথে থাকতে।

 

মা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে প্রথম কোর্টে বসলেন, বাংলাদেশের প্রথম মহিলা ম্যাজিস্ট্রেট গোষ্ঠীর অংশ হিসেবে। এই মহিলা আরেকজন মহা সাহসী মানুষ (এমনিতে ভীতুর ডিম, বাপকে ছাড়া এখনো ঘুমাতে পারেনা রাতে, তার নাকি ভয় লাগে)। তার কোর্টের কার্যকলাপের কাহিনীও সেইরকম। এই মহিলা থাকেন তার বাবার সাথে একটা বাসা ভাড়া করে। নানাকে নিয়ে কুষ্টিয়া শহরের মানুষের অনেক অভিযোগ, মাকে কেউ সামনা সামনি কিছু বলতে পারেনা ভয়ে, কিন্তু তার বুড়া বাবাকে বলাত সহজ। নানাকে একদিন মসজিদ থেকে বের করে দিলেন লোকেরা যে যার অবিবাহিত মেয়ে কোর্টে বসে তার মত “অপবিত্র” লোকের সাথে মসজিদে নামাজ হবেনা। তখন সিনে আসলেন কুষ্টিয়ার তৎকালীন ডিসি নানা। উনি বলে দিলেন যদি তার কর্মকর্তাকে কোনরকম অসম্মান করা হয়, নিজে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করবেন। ঘটনা বদলে গেল রাতারাতি।

 

এবার বাবার কথা। বাবা মায়ের সাথে ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন, একই বিষয়, একই ইয়ার। বিসিএস দিয়ে পোস্টিংও কুষ্টিয়ায়। ছাত্র অবস্থায় অনেক কষ্ট করেছেন, বাসা থেকে পয়সা পেতেন না, নিতেন ও না। দুইখানা কাজ করতেন, তারসাথে পড়াশুনা করেছেন। মা’কে দেখতেন যে ক্লাসে বেশী কথা বলেনা, নিজের মত থাকে, ক্লাস করে, এসে চলে যায়, তখনও ক্লাসমেটদের আপনি করে বলাই বেশী চলতো, মাও আপনি-ই বলতো, কিন্তু কোন ছেলে তুমি করে কথা বললে স্কার্ফ পরা সত্ত্বেও পট করে তুমি করে কথা বলত। মাঝে সাঝে তার বাপ ঢাকায় আসলে নির্দ্বিধায় বাপকে নিয়ে বিকেলে নিউমার্কেটের দোকানে ঘুরত, ফুচকা চটপটি খেত। সেই মেয়ে আবার তার সাথে কলিগ হয়ে পোস্টিং, সেই বাপকে নিয়ে বাপমেয়ের সংসার। বলা উচিত যে আমার বাপ হোল একেবারে বাঙ্গালিদের মতে হ্যান্ডসাম পুরুষ। ফর্সা, লম্বা, কোকরা কাল চুল, ভারি কন্ঠস্বর ইত্যাদি ইত্যাদি। এই মানুষ আমার ডিসি নানাকে বলল মা’কে বিয়ে করতে চায়, উনি বললেন, এই বিষয়ে মতামত দেয়ার মত বুদ্ধি মায়ের আছে, মা’কে সরাসরি বলতে। মা’কে বলায় মা’র মনের কথা ছিল এই “সুন্দর” ছেলে আমাকে বিয়ে করবে কেন! কিন্তু আমার নানার কাছেও কথা গেল। ডিসি নানা, নানা আর বাবা মিলে বিয়ের কথা ঠিক হল। কুষ্টিয়া থেকে খুলনায় গেলেন সবাই। মায়ের বাসায় বাবার পক্ষ থেকে দাদাভাই, ডিসি নানা অফিসিয়াল বিয়ের কথা বললেন। যেদিন কথাবার্তা হচ্ছে সেদিন সকলে হিসেব করে দেখল যে ঐ সপ্তাহের পর বাবা-মায়ের ট্রেনিং আর হাবিজাবি কাজে আগামী ৮-৯ মাস ফ্রি না। ওইদিন রাতে আমার বাবা-মায়ের আকদ হল। তাঁদের বিয়ের কোন প্রোগ্রাম হয়নি, মায়ের বিয়ের শাড়ি বলতে বিশেষ শাড়ি নাই, কিন্তু তাঁদের মতো সুখি মানুষ আমি খুব কম দেখেছি।

 

আমার বাবার মা’ আমার মা’কে খুব পছন্দ করেনি। কোন চাচি-ফুপুও না। কারণ আমার মা কাল। আমার বাবার মতো “সুপুরুষের” পাশে কাল-বেটে মেয়ে মানায়না। মা যখন প্রথমবার তার শ্বশুরবাড়ি যায়, তাঁকে বরণ করার কোন সামাজিকতা হয়নি। বাবাও ট্যারা আছে। অখানে যাওয়ার দ্বিতীয়দিন মাকে বলছে “তোমার আসার শখ, আসছ। বউয়ের শ্বশুরবাড়ি আসার কথা, আসা হইছে। জীবনেও যেন আর এখানে আসার কথা না বলে”। আমার স্বল্পভাষী হাসিমুখের বাবার এই কথা শুনে মা আর কিছু বলেনাই। স্বামীর পিছু পিছু ঘরে হাঁটা দিছে দ্বিতীয় দিনেই। আমি হয়েছি তাঁদের বিয়ের ৪ বছর পর। সেটা নিয়েও অনেক কথা শুনতে হয়েছে আমার বাবা আর মাকে। কিন্তু আমার মা’কে কেউ কোন কথা বলার সাহস পায়নি। মা যখন প্রেগন্যান্ট, আমার দাদী মায়ের রুমে একটা সুন্দর ছেলের ছবি রাখতেন, বাবা অফিস থেকে এসে ছবিটা আলমারিতে ঢুকিয়ে একটা মেয়ের ছবি রাখতেন। মা’কে বলতেন যে “জন্তুদের বছর গড়াতেই বাচ্চা হয়, আমি চাই আমার একটা বাচ্চা হবে, সেটা মেয়ে। নিজের মনের মত তাঁকে মানুষ করবো”। অনেক কাহিনি কিচ্ছা করে আমি হলাম অক্টোবরে, বাবা গল্প করেন যে দুজন ম্যাজিস্ট্রেট-তাঁদের দিন আনে দিন যায়। সিজার করে বাচ্চা হইছে, পয়সা পাবে কই ক্লিনিকের বিল মেটানোর। আর তখন খুলনায় হাসপাতাল এমন ভাল কিছু নাই যে হঠাত ইমারজেন্সি হওয়ায় ক্লিনিক ছাড়া অন্য কোথাও নেয়া যাবে। এই বিলের টাকা যোগাড়ের জন্য আমি হওয়ার ৮দিন পর বাবা আমাদের দেখতে আসছেন। বাবার পোস্টিং তখন শেরপুর। তাও টাকা জোগাড় হয়নাই। অপরাধীর মতো হাসপাতালে গেছেন। মা’র খুব খারাপ অবস্থা ছিল তখন। আমি হওয়ার পরপর আমাকে নাকি আমার নানু আর নানা কোলে নেন নাই, কারণ তারা রাগ ছিলেন আমার উপর যে আমি আমার মা’কে এত কষ্ট দিছি। আমার বাবা আসার পর উনি হাসপাতালে আর কাউকে থাকতে দিতেন না, উনিই রাতদিন থাকতেন। যেদিন মা’কে ছাড়ার কথা, বাবা নাকি মায়ের সামনে কেঁদে দিছেন যে এত অধম বাবা যে তার মেয়ে-বউকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেয়ার প্রায় ৮০০ টাকা তার ছিলনা। মাও কাঁদছেন। পরদিন দুজনের যখন মন খারাপ হওয়া চিন্তায় ডায়রিয়া হওয়ার মত অবস্থা, তখন ডাক্তার এসে বলছে যে আপনার বিলতও পুরাই শোধ করা, রোগীর বাবা আগেরদিন শোধ করে দিয়েছেন। বাবা যখন নানাকে বলেছেন, নানার উত্তর ছিল, তোমার ২৪ দিনের মেয়ের প্রতি তোমার মায়া চিন্তা কর, আর আমার ২৮ বছরের মেয়ের জন্য আমার দরদ কতো সেটাও ভাব, এই মেয়ের চিন্তা যদি বাপ হয়ে আমি না বুঝি তাহলে কে বুঝবে! এই কথাটা আমার বাবা এখনো বেদবাক্যের মত মানে। আমার নানা মারা জান ঐ বছরের ডিসেম্বরে। মারা যাওয়ার আগে তার রিকোয়েস্ট ছিল, তার বড় মেয়ে জানি এমএ পাস করে আর তার দুই ছেলের বৌ যেন এমএ পাস হয়। এই প্রসঙ্গে আরেকটু পর বলছি।

 

আমার বাবা-মা দু’জন খুব ব্রিলিয়ান্ট। বাবা খুব মেধাবী আর মা খুব পরিশ্রমী। আমার যখন তিন বছর বয়স, মা স্কলারশিপ পেলেন বিলেতে এসে এমএ করার। বাচ্চা ছোট, মানুষ তেজি দেখায় বাইরে কিন্তু আসলে একেবারেই (মোমের মানুষ বললেও ভুল হবে) পারদের মানুষ। আমার বাপকে ছেড়ে থাকতে গেলে তার চোখের পানি, নাকের পানি এক হয়ে যায়। সেতো কোনভাবেই পড়তে যাবেনা, তাও যদি বাপের হতো তাও কথা ছিল, স্বামীর স্কলারশিপ হয়নাই, সে কেমনে যাবে! তখন আমার নরম বাপ হুঙ্কার দিল। বলে দিল যদি মা এমন সুযোগ পেয়েও পড়তে না যায়, তাহলে সে মেয়েকে নিয়ে আলাদা পোস্টিং নিয়ে চলে যাবে। একটা বছর মা’কে  নরম-গরম বুঝায় রাজি করাল পড়তে যেতে। আর এই সময়ে আমাকে শিখাত সে, মা’কে বলবা যে তুমি ইংল্যান্ডে না পড়লে আমি কিভাবে পড়ব, তোমাকে যেতে হবে ইত্যাদি। আমিতো ছোট বাচ্চা, পাখিপড়ার মত করে সেটা মা’র কাছে বলতাম, মা খালি কান্না করতো। কিন্তু যেতে বাধ্য হোল শেষ পর্যন্ত। গিয়ে অনেক কান্নাকাটি করতো। নানুকে চিঠি লিখছে “রশীদ আমাকে ফিরতে দিবেনা, আপনি অনুমতি দেন, আমি চলে আসি, আমার মেয়েকে ছাড়া থাকতে আমার কষ্ট হয়”। নানুর উত্তর ছিল “তোমার এক মেয়েকে দূরে রেখে তোমার কষ্ট হয়, আমার পাঁচটা ছেলেমেয়ে দূরে আছে, আমার পাঁচগুণ কষ্ট, আমাকে কষ্টের কথা শুনাতে এসনা”। এই চিঠিও আমার কাছে আছে। মা পড়াশোনা করছে, পিএইচডি করছে, সবই আমার বাপের বিশাল আগ্রহে। যেদিন মায়ের পিএইচডি ডিগ্রীর কনভোকেশন, আমারও এমবিবিএসের কনভোকেশন। আমার বাপের থেকে সুখী মানুষ কেউ ছিলনা ওইদিন। রাতে আমরা বাইরে খেতে গেছি, আমার বাপ খালি একটা কথাই বলছে, আমার শ্বশুর আমাকে শিখাইছে মেয়েকে কিভাবে সম্মান দিতে হয়। আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি, মা’র হিস্টেরেক্তমি হইছে। এমনিতেই আমার দাদি-চাচি-ফুপুদের পছন্দ ছিলনা মা’কে। তারপর আবার একমাত্র মেয়ে তার পেটে জন্ম। ওইসময়ে আমার দাদী কথা শুরু করলেন যে আমার মা জানি আমার বাপকে বুঝায় যে আরেকটা বিয়ে করুক, “বংশের প্রদীপ” জালাক। মা কিছু উত্তর দিতনা। খালি হাসতো, আর আমার তো মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। একদিন রাগের চোটে বাপকে বলছি যে বুবু এমন বলে। আমার বাপ খুব ঠাণ্ডা মানুষ। তাঁকে কখনো আমার দাদির সাথে গলা উচায়ে কথা বলতে দেখিনাই। সেইদিন রাতে খাবার সময় আমার বাপ আমার দাদিকে খুব ঠাণ্ডা গলায় বলছে যে “মা, তোমার আর আমাদের সাথে থেকে লাভ নাই, তুমি দেশে গিয়ে থাক। আমার বউকে এতদিনেও পছন্দ হলনা, আর আমার মেয়ে দেখে তোমার এত কস্ত-এইটা তোমার দেখা লাগবেনা”। বলা বাহুল্য যে আমার দাদির “ফরসা-সুন্দরি” অন্য ছেলের বউয়েরা, মেয়েরা কেউ তাঁকে তাঁদের সাথে থাকতে দিতনা। এখন উনি পুরাই শয্যাশায়ী, বাথরুমও বিছানাতেই। আমার মা তাঁকে দেখে, অন্য মানুষকে পরিষ্কার করতে দেয়না-যদি তারা মুখ গোমড়া করে ওগুলা করে আর তাঁদের বদদোয়া লাগে-এই ভয়ে। বাবা আর মা হোল আমার বুড়া দাদির ২৪/৭ কেয়ারটেকার। কিছুদিন আগে মা খুব অসুস্থ ছিল, আমার এক ফুপুকে আসতে বলছিল কয়কদিনের জন্য- আমার সাদা চামড়ার সুন্দরী ফুপু নিজের মায়ের যত্ন নেয়ার জন্য আসার সময় পান নাই।

 

দুই খালার কথা বাদ পড়ে গেছে মাঝখান দিয়ে। মেজ খালা এখন তিনখানা গার্মেন্টসের এমডি। তার ছেলে-ছেলের বৌ-নাতি-নাত্নি-জামাই নিয়ে সুখের সংসার। মায়ের বিয়ের এক বছর পরই তার বিয়ে হয়েছে। ইজিপ্ট, মালয়শিয়া, জার্মানিতে হিল্লিদিল্লি করে বেরায়। বড় খালার ছেলে যখন ল’তে মাস্টার্স করে, খালা তখন এমএ করছেন, ২০০২ সালে মারা গেছেন, মারা যাওয়ার আগে তাঁরও কথা ছিল তাঁর ছেলের বউয়েরা যেন চাকরিজীবী হয়, পড়াশোনা করা হয়। আর দুইমামার বিয়ের সময় নানুর একটাই চাহিদা ছিল, মেয়েকে এমএ পাস হতে হবে, চাকরিজীবী হতে হবে। আমার বড়মামি খুলনা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, নানু স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ার আগ পর্যন্ত তার কখনো রান্নাঘরের দায়িত্ব নিতে হয়নাই।

 

এই নানার নাতি আর এই বাপের মেয়ে হিসেবে আমি পুরাই ব্যর্থ। কিছুদিন আগে একটা পোস্ট দিছিলাম যে “Behind every successful woman, there’s a supportive dad” । আমার মা-খালার জন্য এটা বড় ধ্রুব সত্য। আর আমি যতটুকু আসতে পারছি জীবনে তার পুরাই আমার বাপের কৃতিত্ব। আমি যখন বরিশাল মেডিকেলে চান্স পাই, আমার ভীতুর ডিম ইমোশনাল মা’টা যেতে দিতে চায়নাই। আমার বাপের কথা ছিল, আমার মেয়ের উপর আমার ৫০০% ভরসা- ওকে যেতে দাও। গত বছর যখন আমি বিলেতে আসার প্রিপারেশন নিচ্ছি, আমার ডিভোর্স পরবর্তী সময়ে ঘুমের ওষুধ ব্যাবহার থেকে শুরু করে অনেক কিছু নিয়ে আমার পাগলা অবস্থা। আমার বাবা আমার সাথে থেকে থেকে, গল্প করে, কথা বলে, আমাকে নিয়ে সাইকলগিস্টের কাছে দৌড়ায়ে মা’কে চ্যালেঞ্জ দিছে যে তার মেয়ে একলা বিলেতে পড়তে এসে বখে যাবেনা। এখনো এই হাজার মাইল দূর থেকে আমাকে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে মানুষটা।

 

আমার বাবামা একটা মেয়েকে এডপ্ট করার প্রক্রিয়ায় আছেন এখন। আমার দাদি-চাচা-চাচি-ফুপুদের কথা ছিল, গরীব একটা বাচ্চাকে যদি এডপ্ট করতেই হতে, মেয়ে বাচ্চা কেন- ছেলে এডপ্ট করলেই হয়। আমার বাপ আবারো সবাইকে বলে দিছে যে এই মানসিকতা হলে তার বাসায় যেন কেউ না আসে।

Leave a comment